চপল পায় কেবল ধাই,
কেবল গাই পরীর গান,
পুলক মোর সকল গায়,
বিভোল মোর সকল প্ৰাণ ৷
শিথিল সব শিলার পর
চরণ থুই দোদুল মন,
দুপুর-ভোর ঝিঁঝিঁর ডাক,
ঝিমায় পথ, ঘুমায় বন ।
বিজন দেশ, কূজন নাই
নিজের পায় বাজাই তাল,
একলা গাই, একলা ধাই,
দিবস রাত, সাঁঝ সকাল ।
ঝুঁকিয়ে ঘাড় ঝুম-পাহাড়
ভয় দ্যাখায়, চোখ পাকায়;
শঙ্কা নাই, সমান যাই,
টগর-ফুল-নূপুর পায়,
কোন গিরির হিম ললাট
ঘামল মোর উদ্ভবে
কোন পরীর টুট্ল হার
কোন নাচের উৎসবে।
খেয়াল নাই-নাই রে ভাই
পাই নি তার সংবাদই,
ধাই লীলায়,-খিলখিলাই
বুলবুলির বোল সাধি ।
বন-ঝাউয়ের ঝোপগুলায়
কালসারের দল চরে,
শিং শিলায়-শিলার গায়,
ডালচিনির রং ধরে ।
ঝাঁপিয়ে যাই, লাফিয়ে ধাই,
দুলিয়ে যাই অচল-ঠাঁট,
নাড়িয়ে যাই, বাড়িয়ে যাই-
টিলার গায় ডালিম-ফাট।
শালিক শুক বুলায় মুখ
থল-ঝাঁঝির মখমলে,
জরির জাল আংরাখায়
অঙ্গ মোর ঝলমলে ।
নিম্নে ধাই, শুনতে পাই
‘ফটিক জল।' হাঁকছে কে,
কণ্ঠাতেই তৃষ্ণা যার
নিক না সেই পাঁক ছেঁকে ৷
গরজ যার জল স্যাচার
পাতকুয়ায় যাক না সেই,
সুন্দরের তৃষ্ণা যার
আমরা ধাই তার আশেই ।
তার খোঁজেই বিরাম নেই
বিলাই তান-তরল শ্লোক,
চকোর চায় চন্দ্রমায়,
আমরা চাই মুগ্ধ-চোখ ।
চপল পায় কেবল ধাই
উপল-ঘায় দিই ঝিলিক,
দুল দোলাই মন ভোলাই,
ঝিলমিলাই দিগ্বিদিক।
১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার কাছাকাছি নিমতা গ্রামে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। ‘তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকার সম্পাদক ও উনিশ শতকের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন তাঁর পিতামহ। সত্যেন্দ্রনাথ বি.এ. শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি কাব্যচর্চা করতেন। দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভাষা, ধর্ম ইত্যাদি বিচিত্র বিষয়ের তিনি অনুরাগী ছিলেন। প্রাত্যহিক জীবনে প্রচুর সময় তিনি অধ্যয়ন ও কাব্যানুশীলনে ব্যয় করতেন। সবিতা, সন্ধিক্ষণ, বেণু ও বীণা, হোমশিখা, কুহু ও কেকা, অভ্র-আবীর, বেলাশেষের গান, বিদায় আরতি প্রভৃতি তাঁর মৌলিক কাব্য। তাঁর অনুবাদ- কাব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে : তীর্থরেণু, তীর্থ-সলিল, ফুলের ফসল প্রভৃতি। বিবিধ উপনিষদ ও কবির, নানক প্রমুখের রচনা এবং আরবি, ফার্সি, চীনা, জাপানি, ইংরেজি, ফরাসি ভাষার অনেক উৎকৃষ্ট কবিতা ও গদ্য রচনা তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন। ছন্দ নির্মাণে তিনি অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। এজন্য তিনি ‘ছন্দের যাদুকর' বলে পরিচিত হন। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন ।
বিভোল— অচেতন, বিভোর, বিবশ, বিহ্বল। বিজন— নির্জন, জনশূন্য, নিভৃত। কুজন— কলরব, চিৎকার, চেঁচামেচি। ঝুম-পাহাড়— নীরব পাহাড়, নির্জন পাহাড়। হিম— তুষার, বরফ, শুক— টিয়ে পাখি। থল- স্থল। ঝাঁঝি- একপ্রকার জলজ গুল্ম, বহুদিন ধরে জমা শেওলা। মখমল- কোমল ও মিহি কাপড়। আংরাখা- লম্বা ও ঢিলা পোশাকবিশেষ। ‘ফটিক জল'- চাতক পাখি। এই পাখি ডাকলে ‘ফটিক জল' শব্দের মতো শোনা যায়। বিলাই— বিতরণ করি, পরিবেশন করি (বিলোনো থেকে)। তান- সুর। তরল শ্লোক- লঘু বা হালকা চালের কবিতা। চকোর - পাখিবিশেষ। কবি-কল্পনা অনুযায়ী এই পাখি চাঁদের আলো পান করে। চন্দ্রমা- চাঁদের আলো। উপল-ঘায়- পাথরের আঘাতে।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ঝরনার গান' কবিতাটি কবির বিদায় আরতি কাব্য থেকে সংকলন করা হয়েছে। কবিতাটিতে অদ্ভুত ধ্বনিব্যঞ্জনায় প্রকাশিত হয়েছে অপূর্ব ভাব । চঞ্চল পা পুলকিত গতিময়; স্তব্ধ পাথরের বুকে আনন্দের পদচিহ্ন। নির্জন দুপুরে পাখির ডাকও শোনা যায় না। পাহাড় যেন দৈত্যের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে ভয় দেখায়! এত কিছুর মধ্যেও ঝরনার চঞ্চল ও আনন্দময় পদধ্বনিতে পর্বত থেকে নেমে আসে সাদা জলরাশির ধারা। চমৎকার এর ধ্বনিমাধুর্য ও বর্ণবৈভব। এই জলধারার যে সৌন্দর্য এবং অমিয় স্বাদ তা তুলনারহিত। গিরি থেকে পতিত এই অম্বুরাশি পাথরের বুকে আঘাত হেনে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে যে অপূর্ব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে তা সত্যি মনোহর।
আরও দেখুন...